‘তালাক’ একটি আরবি শব্দ; যার অর্থ ভেঙে ফেলা, ছিন্ন করা বা ত্যাগ করা। তালাক শব্দের আভিধানিক অর্থ বন্ধনমুক্ত করা। শরীয়তের পরিভাষায় স্ত্রীকে বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্ত করা। আইনসিদ্ধ উপায়ে বিবাহবন্ধন ছিন্ন করাকে তালাক বলে। মুসলিম আইনে তালাক স্বামী-স্ত্রীর একটি বৈধ ও স্বীকৃত অধিকার। যদি স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক তথা দাম্পত্যজীবন এমন অবস্থায় পৌঁছায় যে, একত্রে বসবাস করা উভয়ের পক্ষে বা যে কোনো একজনের পক্ষে সম্ভব নয়, তাহলে সেক্ষেত্রে তারা উভয়েই কিছু নির্দিষ্ট উপায়ে বিয়েবিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন; যার একটি হলো তালাক। তালাক প্রদানের ক্ষমতা বা অধিকার স্বামী ও স্ত্রীর সমান নয়। এক্ষেত্রে স্বামীর একচ্ছত্র অধিকার থাকলেও নির্দিষ্ট কিছু আইনানুগ উপায়ে একজন স্ত্রীও তালাক প্রদান করতে পারেন।
শুধু মুখে তিন তালাক উচ্চারণ করলেই তালাক কার্যকর হয় না। আবার লিখিতভাবে তালাক দিলেও তা সাথে সাথে তা কার্যকর হবে না। আইনের বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করার পর তালাক কার্যকর হবে। তালাক আইন অনুযায়ী তালাক হবে।
তালাক সম্পর্কে জানতে হলে কয়েকটি পরিভাষা জানা আবশ্যক। যথা- ইদ্দত, মাসিক বা ঋতু, পবিত্রকাল, রাজঈ তালাক, বায়েন তালাক, মুগাল্লাযা তালাক ইত্যাদি।
ইদ্দত: তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী ঋতুবতী হ’লে তালাকপ্রাপ্তির পর থেকে তিন ঋতু পর্যন্ত এবং ঋতুবতী না হ’লে তিন মাস বা ৯০ দিন পর্যন্ত শারঈ নিয়মে যে বিশেষ অবস্থায় কালাতিপাত করে তাকে ইদ্দত বলে। ইদ্দত চলাকালে অন্য পুরুষকে বিয়ে করা যায় না। কোন কোন তালাকে ইদ্দতকালে বিয়ে বহাল থাকে এবং স্বামী চাইলে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারে। এরূপ ক্ষেত্রে ইদ্দতকালে স্বামী মারা গেলে স্ত্রী তার ওয়ারিশও হবে।
মাসিক: প্রাপ্তবয়স্কা নারীদের সাধারণতঃ প্রতি মাসে একবার গর্ভাশয় থেকে রক্তস্রাব হয়। একে মাসিক বা ঋতু বলে। মাসিকের আরবী প্রতিশব্দ ‘হায়েয’ (الحيض)। সাধারণতঃ তিন থেকে দশ দিন এই রক্ত নির্গত হয়। মাসিকের সময় তালাক দেওয়া শরী‘আতে নিষিদ্ধ।
পবিত্রকাল: দুই মাসিকের মধ্যবর্তী সময়কালকে পবিত্রকাল বলে। পবিত্রকালের আরবী প্রতিশব্দ ‘তুহুর’ (الطهر)। তালাক এই পবিত্রকালে সহবাসমুক্ত অবস্থায় দিতে হয়। অবশ্য যাদের মাসিক শুরু হয়নি কিংবা বয়সজনিত কারণে বন্ধ হয়ে গেছে তারা সব সময় পবিত্রকালের মধ্যে গণ্য। তাদের তালাকদানে সহবাস থেকে মুক্ত হওয়ার কথা নেই।
রাজঈ তালাক: যাদের মাসিক হয় এমন নারীদের পবিত্রকালে সহবাসমুক্ত অবস্থায় এবং যাদের মাসিক হয় না তাদের যেকোন অবস্থায় এক তালাক দিলে ইদ্দতকাল পর্যন্ত উক্ত তালাককে রাজঈ তালাক বলে। রাজঈ অর্থ ফিরে আসা, প্রত্যাহার করা। এরূপ তালাকে ইদ্দতের মধ্যে তালাক প্রত্যাহার করে স্ত্রীর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে ফিরে আসা যায়। তাই একে রাজঈ তালাক বলে। বৈবাহিক সম্পর্ক পুনরায় স্থাপনের পর স্বামী দুই তালাকের মালিক থাকবে। এর মধ্যে স্বামী চাইলে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারবে।
বায়েন তালাক: রাজঈ তালাক দেয়ার পর ইদ্দতের মধ্যে স্বামী স্ত্রীকে ফিরিয়ে না নিলে উক্ত রাজঈ তালাক ইদ্দত শেষ হওয়ার সাথে সাথে বায়েন তালাকে পরিণত হবে। বায়েন অর্থ বিচ্ছিন্নকারী। অর্থাৎ তালাক বায়েন হওয়ার সাথে সাথে বিবাহ পুরোপুরি ছিন্ন হয়ে যাবে। এবার স্ত্রী চাইলে অন্য পুরুষকে বিয়ে করতে পারবে, আবার চাইলে তালাকদাতা স্বামীকেও নতুনভাবে বিয়ে করতে পারবে। বায়েন তালাকও দু’বার পর্যন্ত সিদ্ধ। অবশ্য বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীর সাথে সহবাস কিংবা নির্জনবাসের পূর্বেই তালাক দিলে তৎক্ষণাৎ তা এক তালাক বায়েন বলে গণ্য হবে।
মুগাল্লাযা তালাক: দুই তালাক রাজঈ কিংবা দুই তালাক বায়েনের পর স্বামীর হাতে থাকা এক তালাকও দিয়ে দেয়া হ’লে তাকে মুগাল্লাযা তালাক বলে। মুগাল্লাযা অর্থ চূড়ান্ত। এই তালাকের পর ইদ্দতের মধ্যে কিংবা শেষে স্ত্রীকে আর ফিরিয়ে নেয়া যাবে না। এবার স্ত্রী স্বাধীনভাবে অন্য পুরুষকে বিয়ে করবে। তারপর উক্ত স্বামীও যথা নিয়মে তালাক দিলে কিংবা মারা গেলে প্রথম স্বামীকে চাইলে সে পুনরায় বিয়ে করতে পারবে। অতএব তালাক প্রথমে রাজঈ তারপর বায়েন এবং সর্বশেষে মুগাল্লাযায় পরিণত হয়।
তালাকের প্রকারভেদ
১. স্বামী কর্তৃক তালাক: তালাক দেওয়ার অধিকার বা ক্ষমতা স্বামীর সবচেয়ে বেশি। কোন কারন ব্যতীত স্বামী তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিতে পারে। স্বামী কর্তৃক প্রদত্ত তালাককে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে :
(ক) তালাকে আহসান
(খ) তালাকে হাসান বা ভালো তালাক এবং
(গ) তালাকে বিদ’আত
(ক) আহসান তালাক: এক তালাক প্রদান করে মুদ্দত অতিক্রান্ত করাকে আহসান তালাক বলে। এক্ষেত্রে সহবাস মুক্ত তুহুরে তালাক প্রদান করা। অতঃপর আর কোনো তালাক প্রদান না করা। যে পর্যন্ত না ঐ স্ত্রীর ইদ্দত খতম হয়ে যায় এবং গর্ভবর্তী থাকলে তার গর্ভ ভুমিষ্ট হয়ে যায়।
(খ) তালাকে হাসান: তালাকে হাসান হলো সহবাস মুক্ত তুহুরে তালাক প্রদান করা। অতঃপর দ্বিতীয় সহবাস মুক্ত তুহুরে দ্বিতীয় তালাক দেয়া। অতঃপর তৃতীয় সহবাস মমুক্ত তুহুরে তৃতীয় তালাক প্রদান করা।
প্রথম ও দ্বিতীয় তালাকের পর রাজআত করা যায়। তথা ইদ্দতের ভিতর স্বামী তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। এরজন্য কোনো আনুষ্টানিকতার প্রয়োজন নেই। রাজআত হল ইদ্দতের ভিতরে বিয়েকে টিকিয়ে রাখা, স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা।
(গ) তালাকে বিদ’আত: তিন তুহূরের মধ্যে তিন তালাক প্রধান করাকে তালাকে বিদ’আত বলে। একসাথে তিন তালাকের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে নিয়ে আর পুনরায় ঘর করা যাবে না। আর সেই তালাক সাথে সাথেই পূর্ণ হয়ে গেল। পুনরায় বিবাহ করে ঘর-সংসার করার আর কোন সুযোগ থাকলো না। তবে যদি ভবিষ্যতে উক্ত মহিলার অন্যের সাথে বিবাহের পর পুনরায় সে যদি তালাকপ্রাপ্ত হয় বা তার স্বামী মারা যায়, তাহলে সে প্রথম স্বামীর সাথে ইচ্ছা করলে বিবাহ বসতে পারবে বা উক্ত পুরুষ তাকে ইচ্ছা থাকলে বিবাহ করে ঘর করতে পারবে।
কুরআনী নীতি অনুযায়ী তিন তুহূরে তালাক না দিয়ে যদি কেউ অন্যায়ভাবে একই সাথে তিন তালাক দেয়, তবে সে তালাক বর্তাবে কি-না, এ বিষয়ে বিদ্বানগণের মতভেদকে চারভাগে বিভক্ত করা যায়। একদল বিদ্বান বলেন, এর দ্বারা কিছুই বর্তাবে না। ২য় দল বলেন, তিন তালাক পতিত হবে। কিন্তু ঐ ব্যক্তি গোনাহগার হবে। ৩য় দল বলেন, সহবাসকৃত নারীর উপরে তিন তালাক বর্তাবে ও সহবাসহীন নারীর উপরে এক তালাক বর্তাবে। ৪র্থ দল বলেন, এক তালাক রাজঈ হবে।
তিন তালাক পবিত্র কুরআন ও রাসূলুল্লাহ (স:)-এর সুন্নাত বহির্ভূত সেহেতু তা বিদ‘আত ও প্রত্যাখ্যাত। বাংলাদেশে কেউ যদি তিন তালাকের বিরুদ্ধে আইনগত সুরক্ষা চায় তাহলে তাকে সেটি দেয়া হয়। কারণ তিন তালাক উচ্চারণের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ বাংলাদেশে বৈধ নয়। কিন্তু ‘তিন তালাক’ উচ্চারণের মাধ্যমে কেউ বিবাহ বিচ্ছেদ করতে চাইলে তাকে শাস্তি দেবার বিধান নেই। তবে সে তালাক আইনগতভাবে কার্যকরী হবে না।
২. স্ত্রী কর্তৃক তালাক: আইনে বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার স্ত্রীকে দেওয়া হয়েছে। কাবিননামার ১৮ নম্বর কলামটিতে যদি আপনাকে তালাকের ক্ষমতা প্রদান করা হয়ে থাকে, তাহলে আপনি সরাসরি তাঁকে তালাক দিতে পারেন। আর ১৮ নম্বর কলামে যদি কোনো ক্ষমতা না দেওয়া থাকে, তাহলে আদালতে যেতে হয়। স্ত্রীর তালাকের ক্ষমতা না থাকলে পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে তালাকের ডিক্রি নিতে হয়। স্ত্রী তিন ভাবে স্বামীর কাছ থেকে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে পারে। যথা– ১. তালাক-ই-তৌফিজ; ২. খুলা; এবং ৩. আদালতের মাধ্যমে বিচ্ছেদ।
তালাক-ই-তৌফিজ: তালাক-ই-তৌফিজ মুসলিম আইনে একটি কার্যকর সংযোজন৷ তালাক-ই-তৌফিজ স্ত্রীর নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নয়৷ এটি স্বামী কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতা৷ নিকাহনামা বা কাবিননামার ১৮ নং ঘরে স্বামী স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা অর্পণ করেছে কিনা? করে থাকলে কি শর্তে? এই প্রশ্নটি ছাপা থাকে৷ স্বামীর যে তালাক দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে সে ক্ষমতাটি যদি স্বামী স্ত্রীকে কাবিননামার ১৮ নং ঘর পূরণের মাধ্যমে প্রদান করে তবে স্ত্রী নিজ থেকে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন৷ স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা শর্তযুক্ত বা শর্তহীন হতে পারে৷ স্ত্রী কর্তৃক এরূপ তালাক উচ্চারণ করা হলে বা বিয়ে ছিন্ন করা হলে সে তালাকের নাম তালাক-ই-তৌফিজ৷ এক্ষেত্রে যেহেতু স্ত্রী তালাক দিচ্ছেন তাই তালাক সংক্রান্ত নোটিশ চেয়ারম্যানের কাছে এবং এর কপি স্বামীর কাছে পাঠাতে হবে৷ নোটিশ পাঠানোর কাজটি ডাকযোগেও হতে পারে, আবার সরাসরিও হতে পারে। ডাকযোগে রেজিস্ট্রি করে এডি (অ্যাকনলেজমেন্ট ডিউ) সহযোগে পাঠালে ভালো হয়।
৩. পারস্পারিক সম্মতিতে তালাক:
ক) খুলা – স্ত্রী আরেকটি উপায়ে স্বামীকে তালাক/বিচ্ছেদ দিতে পারে। এটি হচ্ছে খুলা, যা চুক্তিভিত্তিক বিচ্ছেদ হিসেবেও পরিচিত। অর্থাৎ যখন কোন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা হচ্ছে না বা স্ত্রী স্বামীর উপর বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন তখন স্ত্রী চাইলে প্রতিদানের (অর্থ বা সম্পত্তি) বিনিময়ে স্বামীকে বিচ্ছেদ ঘটাতে রাজী করাতে পারে। এই ধরনে বিচ্ছেদকে খুলা বলে। এক্ষেত্রেও স্ত্রী’কে চেয়ারম্যানের কাছে নোটিশ পাঠাতে হবে৷ খুলা তালাকের ক্ষেত্রে স্ত্রীদের দেনমোহরের বিনিময়ে স্বামীকে রাজী করানোর বিষয়টি বেশী প্রাধান্য পায়। স্ত্রীর এরূপ বিচ্ছেদের প্রস্তাবটি স্বামী কর্তৃক অগ্রাহ্য হলে স্ত্রী আদালতের শরণাপন্ন হতে পারেন।
খ) মুবারত – মুবারাতও খুলার মত এক ধরণের চুক্তি ভিত্তিক বিবাহ বিচ্ছেদ। যখন স্বামী এবং স্ত্রী একে অন্যের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন তখন তারা মুবারতের মাধ্যমে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন। খুলা এবং মুবারত উভয়ই চুক্তিভিত্তিক বিচ্ছেদ হলেও উভয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। খুলা হচ্ছে এককভাবে বিরূপ মনোভাবসম্পন্ন স্ত্রীর পক্ষ থেকে প্রতিদানে বিনিময়ে বিচ্ছেদ ঘটানো। আর মুবারত হচ্ছে, উভয়ে যখন উভয়ের প্রতি বিরূপ মনোভাব সম্পন্ন হয়, তখন উভয়ের সম্মতিতে বিচ্ছেদ। মুবারতের ক্ষেত্রেও চেয়ারম্যানের কাছে নোটিশ পাঠাতে হবে। এক্ষেত্রে যিনি বিচ্ছেদের প্রস্তাব দিবেন নোটিশ পাঠানোর দায়িত্ব তার।
৪. আদালত কর্তৃক বিচ্ছেদ: ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইনের অধীনে স্ত্রী নিম্নোক্ত ৯টি কারণের যে কোনো এক বা একাধিকের ভিত্তিতে আদালতে বিবাহ বিচ্ছেদ বা তালাকের জন্য আবেদন করতে পারবেন। যথা:
(১) স্বামী ৪ বছরের অধিক সময় নিরুদ্দেশ থাকলে;
(২) দুই বছর যাবৎ স্ত্রীর ভরপোষ দিতে স্বামী ব্যর্থ হলে;
(৩) স্বামী ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের বিধান লঙ্ঘন করে স্ত্রীর অনুমতি ব্যতীত পুনরায় বিয়ে করলে;
(৪) স্বামী সাত বছর বা তার বেশি সময় কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে;
(৫) কোনো যুক্তি-সঙ্গত কারণ ছাড়া তিন বছর ধরে স্বামী তাঁর দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে;
(৬) স্বামী বিয়ের সময় পুরুষত্বহীন থাকলে এবং তা মামলা দায়ের করার সময় পর্যন্ত বজায় থাকলে;
(৭) স্বামী দুই বছর ধরে পাগল থাকলে অথবা মারাত্মক যৌনব্যাধিতে আক্রান্ত থাকলে;
(৮) নাবালিকা অবস্থায় বিয়ে হয়ে থাকলে অথবা সাবালকত্ব লাভের পর অর্থাৎ ১৮ বছর পূর্ণ হবার পর স্ত্রীর বিয়ে অস্বীকার করলে (কিন্তু এক্ষেত্রে স্বামীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে থাকলে এরকম মামলা দায়ের করা যাবে না)
(৯) স্ত্রীর সাথে স্বামী নিষ্ঠুর আচরণ করলে; যেমন-
(ক) স্ত্রীকে শারীরিক বা মানসিকভাবে নির্যাতন করলে।
(খ) স্বামীর কোন অবৈধ সম্পর্ক থাকলে।
(গ) স্ত্রীকে নৈতিকতা-বর্জিত জীবন যাপনের জন্য বাধ্য করা।
(ঘ) স্ত্রীর অমতে তার সম্পত্তি হস্তান্তর করলে কিংবা স্ত্রীকে তার সম্পত্তির ওপর বৈধ অধিকার প্রয়োগে বাধা দিলে।
(ঙ) স্ত্রীকে তার ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনে বাধা দেওয়া।
(চ) যদি স্বামীর একাধিক স্ত্রী থাকে, তবে পবিত্র কোরানের নির্দেশে তাদের সাথে সমান ব্যবহার না করা হলে।
হিন্দু আইনে বিবাহবিচ্ছেদ
বিবাহ বিচ্ছেদের ধারণা সাধারণভাবে গৃহীত বা অনুমোদিত হলেও হিন্দু আইন অনুযায়ী স্বীকৃত নয়। হিন্দু সমাজে বিবাহকে দেখা হয় স্বামী ও স্ত্রীর ধর্মীয় কর্তব্য সম্পাদনের উদ্দেশ্যে পবিত্র মিলন হিসেবে। হিন্দু ধর্মদর্শন বৈবাহিক সম্পর্ককে ‘অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক’ হিসেবে গণ্য করে। ঋষি মনু বিশ্বাস করতেন যে, স্ত্রীর কর্তব্য এমনকি মৃত্যুর পরও চলতে থাকে। তাই তার কখনোই দ্বিতীয় স্বামী থাকতে পারে না। কারণ, হিন্দু পুরাণতত্ত্ব অনুযায়ী বিবাহের মধ্য দিয়ে স্বামী ও স্ত্রীর মাঝে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক তৈরি হয়। এ কারণেই হিন্দু প্রথা অনুযায়ী বিবাহ বিচ্ছেদ স্বীকৃত না বলে কোনো পক্ষই একে অন্যকে ডিভোর্স দিতে পারে না।
হিন্দু মতবাদের দায়ভাগ আইনে (যা বাংলাদেশে প্রচলিত) ডিভোর্স স্বীকৃত নয়। যদিও মিতাক্ষরা আইনে ডিভোর্স বেশ কিছু ক্ষেত্রে স্বীকৃতি পেয়েছে। তবে ভারতে ১৯৫৫ সালের হিন্দু বিবাহ আইনে কতিপয় বিশেষ ক্ষেত্রে আনীত অভিযোগ প্রমাণ সাপেক্ষে বিবাহবিচ্ছেদ সম্ভব হলেও বাংলাদেশে এ আইন প্রযোজ্য নয়।
খ্রিস্টান ধর্মে বিবাহবিচ্ছেদ
খ্রিস্টানদের জন্য বিবাহবিচ্ছেদের ব্যাপারে আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় আইন রয়েছে, তা ব্রিটিশ কর্তৃক প্রবর্তিত, যা ১৮৬৯ সালের ক্রিশ্চিয়ান ডিভোর্স অ্যাক্ট নামে পরিচিত। কিন্তু এ আইনের কোনো ক্যাথলিক খ্রিস্টানের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটালে তা গ্রহণীয় নয়। প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান সম্প্রদায় বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে বৈধ বিয়ের বিচ্ছেদ মেনে নেয়। তবে, বিশেষ বিবেচনায় অথবা চার্চের হস্তক্ষেপে কিছু ক্ষেত্রে ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ হতে দেখা যায়।
উল্লেখ্য, ১৮৬৯ সালের ক্রিশ্চিয়ান ডিভোর্স অ্যাক্টের বিবাহবিচ্ছেদের ব্যাপারে নারীকে অধিকার প্রদান করা হয়েছে। বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, স্ত্রীর ক্ষমতা ও অধিকারকে স্বামীর পাশাপাশি সমুন্নত রাখা হয়েছে এবং স্ত্রীকেও স্বামীর পাশাপাশি সমতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ–১৯৬১ অনুযায়ী তালাকের বিধান
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৭ (১) ধারা অনুযায়ী, স্বামী তালাক দেবার পরপরই তালাক দেবার সংবাদটি একটি নোটিশের মাধ্যমে চেয়ারম্যানকে জানাতে হবে। যদি কোন ব্যক্তি উপধারার ১ নং বিধান লঙ্ঘন করেন তাহলে সে এক বছর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদন্ড বা দশ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড অথবা উভয় প্রকার দন্ডে দন্ডিত হবে।
মনে রাখতে হবে, নোটিশ পাবার ত্রিশ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পুনর্মিলন ঘটানোর উদ্দেশ্যে উভয়পক্ষের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সালিশী পরিষদ গঠন করবেন এবং তাঁদের মধ্যে মিমাংসা/সমাধান আনার প্রয়োজনীয় সমস্ত ব্যবস্থা নেবেন।
উপধারার ৫ নং বিধান অনুযায়ী অন্য কোনভাবে প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে কোন তালাক পূর্বাহ্নে প্রত্যাহার না করা হলে উপধারা ১ অনুযায়ী চেয়ারম্যানের নিকট প্রেরিত নোটিশের তারিখ হতে ঌ০ দিন অতিরিক্ত না হওয়া পর্যন্ত উক্ত তালাক কার্যকর হবে না।
স্ত্রী কর্তৃক তালাক প্রদানের সময় স্ত্রী গর্ভবতী থাকলে উপধারা ৩ এ বর্ণিত মেয়াদ বা গর্ভকাল- এই দুই-এর মধ্যে যা পরে হবে তা অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকর হবে না।
যদি সালিশে কাজ না হয় এবং নোটিশ দেবার ৯০ দিনের মধ্যে নোটিশ প্রত্যাহার না করেন, তাহলে ৯০ দিন পরে তালাক কার্যকর হবে। ৯০ দিন পার না হওয়া পর্যন্ত দম্পতিকে আইনসিদ্ধ স্বামী-স্ত্রী হিসেবেই ধরা হবে এবং স্ত্রী ভরণপোষণ পাবেন।
মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ ১৯৬১ -এর ৭(১) নং ধারা অনুযায়ী – চেয়ারম্যান ও স্ত্রীকে নোটিশ না পাঠালে স্বামী শাস্তি পাবেন ঠিকই, কিন্তু তালাক বাতিল হবে না। তালাক কার্যকরী হবে।
তালাক নোটিশ পূরণের নিয়ম
স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষেত্রে নোটিশে নিন্মোক্ত বিষয় সুনির্দিষ্ট ভাবে উল্লেখ করতে হবে। যেমন:
১। স্বামীর পূর্ণ নাম (কাবিন নামার সাদৃশ্য- ভোটার আইডি, জন্ম নিবন্ধন ও পাসপোর্ট মোতাবেক)
২। পিতা-মাতার নাম
৩। স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা
৪। বিবাহের তারিখ ও মোহরানার অংশ
৫। কাবিন নামার নাম্বার এবং বিবাহ রেজিস্ট্রীর তারিখ (কাজী অফিসের নাম উল্লেখ পূর্বক)
৬। স্ত্রীর নাম, পিতা ও মাতার নাম
৭। স্ত্রীর বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা
৮। তালাক প্রদানের আইন সম্মত কারন এক বা একাধিক
৯। যেদিন তালাক প্রদান করা হয়েছে
১০। কোন বিশেষ বক্তব্য, শর্তাদি বা ফরমান
১১। তালাক প্রদানের প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী (২ জন)
১২। তালাক দাতার স্পষ্টাক্ষরে স্বাক্ষর
১৩। অনুলিপি প্রাপকের পরিচয়